শুক্রবার, ০৫ মার্চ ২০২১, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশে ফোকলোর সংগ্রহ ও গবেষণায় ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য ও ড. আশরাফ সিদ্দিকী লোকসাহিত্যের বিচিত্র ধারা সম্পর্কে যে নান্দনিক বর্ণনার উপস্থাপন করেছেন সে কারণেই তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ড. মযহারুল ইসলামের গুরুত্ব এক্ষেত্রে আরও গভীরে। যার প্রমাণ মেলে ‘ফোকলোর: পরিচিত ও পঠন-পাঠন’ শিরোনামের গ্রন্থটি পাঠ করলে। এই গ্রন্থে তিনি কেবল বর্ণনার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সংজ্ঞা, শ্রেণীবিভাগ, প্রতিশব্দ, সংগ্রহ, মেথড, লোককাহিনীর পাঠ পরিভ্রমণ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর গুরুত্ব ও চর্চা সর্বোপরি ফোকলোর সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক ধারণার অবতারণা করেছেন।
এ বিষয়ে তিনি নিজেই তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন- ‘অধ্যাপক ড. ভট্টাচার্য এবং অধ্যাপক ড. সিদ্দিকীর যেখানে সমাপ্তি সেখান থেকেই সূচিত হয়েছে আমার যাত্রাপথ। আমি আমার বর্তমান গ্রন্থের কলেবর প্রথম থেকেই পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণামূলক রীতিতে গড়ে তুলতে যত্নবান হয়েছি। আমার এই সযত্ন ও সচেতন প্রয়াসে আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল আমাদের লোকসাহিত্যের পঠন-পাঠনে এমন কতগুলো তথ্য, পদ্ধতি, রীতি ও বৈজ্ঞানিক চেতনা পরিবেশন করা যা কিনা এদেশে প্রায় সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত”।১
যখন বহির্বিশ্বে ফোকলোরকে লোকগোষ্ঠির জ্ঞান ও জীবনাচরণের মূল হিসাবে দেখা হচ্ছে তখন আমাদের দেশে ফোকলোর বলতে কেবল লোকসাহিত্যের কতগুলো শাখাকেই বোঝানো হতো। কিন্তু পরবর্তীতে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং তার অন্তরালে পথিকৃতের ভূমিকা রাখেন ড. মযহারুল ইসলাম।
মূলত এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় ফোকলোর গবেষণায় ড. মযহারুল ইসলামের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। এ আলোচনার জন্য ড. ইসলামের লেখা ‘ফোকলোর: পরিচিতি ও পঠন-পাঠন’ গ্রন্থটির মূল্য সর্বাধিক। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ শ্রাবণ ১৯৭৫; আগস্ট ১৯৬৭ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে। প্রথম সংস্করণে বইটির নাম ছিল ‘লোকলোর পরিচিতি ও লোকসাহিত্যের পঠন-পাঠন’। তৃতীয় সংস্করণে এসে গ্রন্থটির বর্তমান নামটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
গ্রন্থটির অধ্যায়গুলির শিরোনামই বলে দেয় ফোকলোর বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার ক্ষেত্র নির্মাণে এর গুরুত্ব কতটা অপরিসীম। এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ফোকলোর পরিচিতি, সংজ্ঞা, উপাদান ও শ্রেণীবিভাগ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ফোকলোরের বাংলা প্রতিশব্দের জটিলতার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়টিতে ফোকলোর সংগ্রহকৌশল ও গবেষণা পদ্ধতির প্রতি গুরুত্ব স্থান পেয়েছে। চতুর্থ অধ্যায় মূলত ফোকলোর সম্পর্কিত প্রচলিত মতবাদ নিয়ে আলোচনা। পঞ্চম অধ্যায় লোকসংগীতের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও লোককাহিনীর পাঠান্তরের ওপর দৃষ্টি প্রয়োগ। ষষ্ঠ অধ্যায়ে ফোকলোরের উপাদানের বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে তুলনামূলক আলোচনা এবং সপ্তম অধ্যায়ে প্রবাদে মেটাফোকলোর ও বর্তমান বিশ্বে ফোকলোর নিয়ে আলোচনা। সুতরাং গ্রন্থটির সূচিপত্রের ভিন্নতাই এর গভীরে যাবার ক্ষেত্রে পাঠককে আকৃষ্ট করে। মূলত সমগ্র বাংলায় ড. ইসলামের পূর্বে ফোকলোর চর্চায় এমন তত্ত্ব ও তথ্যভিত্তিক অবদান কেউ রাখতে পারেননি। আমরা যখন Folklore শব্দটির সাথে পরিচিত হয়েছি তখন সেটি এক শব্দে রূপান্তরিত, কিন্তু পূর্বে মাঝখানে একটি হাইফেন দিয়ে Folk & Lore শব্দ দুটিকে ব্যবহার করা হতো। ১৮৭৮ সালে ইংল্যান্ডে Folklore Society প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই সোসাইটির মুখপত্র পত্রিকাটির নাম Folklore Records এবং পরে Folk-Lore নামে প্রকাশ হতো। পরবর্তী কালে মাঝখানে হাইফেন তুলে দিয়ে বর্তমান Folklore অর্থাৎ একটি শব্দের প্রচলন ঘটে।
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ফোকলোরকে বহুবিদ্যা-শৃঙ্খলার ধারায় ড. ইসলাম অল্প কথায় সামগ্রিকভাবে সংজ্ঞায়িত রূপ দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে পুরুষানুক্রমিক সব বিষয়ই ফোকলোরের অন্তর্গত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি ALAN DUNDES এর একটি সংজ্ঞার উদ্ধৃতিও প্রদান করেন- Since materials other than Folklore are also orally transmitted the criterion of oral transmission by itself, is not sufficient to distinguish Folklore from non Folklore এবং ড. ইসলামই বাংলায় প্রথম বলেন এ শুধু মৌখিক ধারা নয় এমন কিছু লিখিত ধারাও আছে যা ফোকলোরের অন্তর্গত। অর্থাৎ লোকগোষ্ঠীর মৌখিক ও লিখিত সৃষ্টির আন্তঃসংযোগের বিষয়টিকেও তিনিই প্রথম গবেষকদের সম্মুখে আনেন।
প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের দেশে ফোকলোরকে সনাক্ত করার বিষয়টি ছিল সুর দেখে হাতি চেনার মত। মৌখিক সাহিত্যকেই ফোকলোর বলে আখ্যায়িত করা হতো। অর্থাৎ ছড়া, প্রবাদ লোককাহিনী, সঙ্গীত, ধাঁধা মানেই ফোকলোর অথচ ড. মযহারুল ইসলাম একটি বাক্যের মধ্যে দিয়ে বিষয়টিকে সহজবোধ্য এবং সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘ফোকলোর হলো সৃষ্টিমূলক লোকজ্ঞান’। অতএব খুব সহজভাবে বলা যায় অভিজ্ঞ লোকায়ত সমাজে বাসরত Mass people এর সৃষ্টিলব্ধ শৈল্পিক জ্ঞানই Folklore।
গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি উপাদানের ভিত্তিতে ফোকলোরের সুশৃঙ্খল একটি শ্রেণীবিভাগকে উপস্থাপন করেন, যা বর্তমান ফোকলোর গবেষকদের কাছেও অনুসরণের বিষয়- বাক্কেন্দ্রিক ফোকলোর, অঙ্গভঙ্গি কেন্দ্রিক ফোকলোর, আচার ব্যবহারগত ফোকলোর, খেলাধূলা কেন্দ্রিক ফোকলোর, বস্তুকেন্দ্রিক ফোকলোর, লিখন কেন্দ্রিক ফোকলোর,
সেই সাথে সমগ্র ফোকলোরকে তিনি বৃহৎ দুটি ভাগেও বিভক্ত করে দেখান বস্তুগত ফোকলোর আর অবস্তুগত ফোকলোর এবং পর্যায়ক্রমে লোকসাহিত্যের এই শ্রেণীবিভাগ এবং উপাদানগুলোর আলোচনা করেন। লোককাহিনী, লোকসংগীত, ছড়া, প্রবাদ, ধাঁধা ইত্যাদির শ্রেণীকরণ ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনার সূত্রপাত ঘটান। লোককাহিনীর আলোচনায় তিনি বাংলার সাথে বহির্বিশ্বের লোককাহিনীর তুলনা দেখান এবং আন্তর্জাতিকভাবে এই কাহিনীর অর্থগুলো যে একই ভাব প্রকাশ করে সেটাই তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। বোকা জামাই, ধূর্ত শিয়াল এইসব কাহিনী পৃথিবীর বহুদেশেই কম বেশি প্রচলিত তাই এর পাঠান্তর বিশ্লেষণেও তিনি আগ্রহী হন।
গ্রন্থটির এই অধ্যায়েই ড. ইসলাম ফোকলোর এর বাংলা প্রতিশব্দ নিয়ে যে ব্যাপক জটিলতা সৃষ্টি হয়ে চলেছে তারই ধারাবাহিক আলোচনা করেন। এই প্রবন্ধে তিনি সমস্যার অনেকটাই যুক্তিযুক্ত সমাধানে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন। তবে তাঁর এ আলোচনার পূর্বেই সমগ্র ভারত উপমহাদেশের বহু প-িত এবং গবেষক এই ফোকলোর শব্দটির বহু বাংলা প্রতিশব্দ দাঁড় করিয়েছেন।
Folk অর্থ লোক আর Lore অর্থ জ্ঞান এককথায় ‘লোকজ্ঞান’। কিন্তু এর দ্বারা বিষয়টির সামগ্রিক রূপটিকে তুলে ধরা যায়না। বিভিন্ন গবেষক এক্ষেত্রে লোকজ্ঞান, লোকবিদ্যা, লোকযান, লোকতত্ত্ব, লোকবিজ্ঞান, লোককলা, লোকসাহিত্য, লোকশ্রুতি, লোকসংস্কৃতি, লোকবৃত্ত ইত্যাদি প্রতিশব্দ ব্যবহার করেছেন এবং করছেন। অথচ Lore এর অর্থ লোক এটা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই যত মতান্তর সমস্তটাই Lore শব্দটিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ড. ইসলাম দেখান এসব গবেষকদের উল্লিখিত প্রতিটি প্রতিশব্দেরই যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে যা ফোকলোরকে বোঝাবার পক্ষে প্রবল যুক্তিযুক্ত নয়। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও ফোকলোরকে লোকলোর বলে আখ্যায়িত করেন। এই গ্রন্থটির নামকরণের প্রথম পর্যায়েই তা প্রতীয়মান হয়। তিনি লক্ষ্য করেন লোকলোর হিসাবে পাঠক ও গবেষক সেভাবে গ্রহণ করছে না। এমনই এক পর্যায়ে তিনি নিজেই বলেন যে ‘ফোকলোর বনাম লোকলোর’ প্রবন্ধে আমি ফোকলোর শব্দের জন্য অনেক জোড়ালো এবং অকাট্য যুক্তি প্রদর্শন করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার ছাত্রদের মধ্যে শব্দটি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও বৃহত্তর সুধী সমাজে শব্দটি যথারীতি স্বীকৃতি লাভ করেনি”।২
তাঁর এই মন্তব্য থেকেই সুস্পষ্ট ধারণা করা যায় তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেন Folklore শব্দটিকে বাংলায় ফোকলোরই রাখা যায় এবং তাতেই এর শাব্দিক জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তিনি Folklore শব্দটিকে বাংলা ফোকলোর শব্দরূপে প্রতিষ্ঠা দেবার লক্ষ্যে শব্দটির পক্ষে যথেষ্ট জোড়ালো যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। হাইজাক, এ্যারোপ্লেন কিংবা কলেজ এই শব্দগুলোর ব্যবহার দিয়ে দেখিয়েছেন বাংলার চেয়ে ইংরেজীই এক্ষেত্রে এতটাই সহজবোধ্য, জনপ্রিয় এবং পরিচিত হয়েছে যে মহাবিদ্যালয় অথবা উড়োজাহাজ যেনো বাংলা নয় ইংরেজী বা বিদেশী শব্দ।
ঠিক তেমনি ফোকলোর শব্দটির ক্ষেত্রেও এই ধারাটির পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে। অর্থাৎ ড. ইসলাম ফোকলোর শব্দটির প্রতিশব্দ চয়নের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক অবস্থানের প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। কারণ পাশ্চাত্যে যেহেতু ফোকলোর নামটিই ব্যাপক আলোচিত সেহেতু বাংলাতেও ফোকলোর রাখাটাই যথার্থ।
সংগ্রহ এবং সংগ্রাহক এই বিষয়গুলো নিয়ে গ্রন্থটির তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা লক্ষ্য করা যায়। ড. মযহারুল ইসলাম এখানে ফোকলোরের উপাদান সংগ্রহ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ধারা অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। এবং এখানে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন মাঠ পর্যায়ের সংগ্রহকর্মের মাধ্যমেই বিজ্ঞান ভিত্তিক সমগ্র ফোকলোরের পঠন-পাঠনকে প্রতিষ্ঠিত রূপ প্রদান করা সম্ভব। পর্যালোচনা গবেষণা এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সংগ্রাহকদের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে একথা তিনিই পূর্ণাঙ্গরূপে উপলব্ধি করেন এবং তার গুরুত্ব পাঠককুলকে অনুধাবন করাতে সচেষ্ট হন তাঁর এই প্রবন্ধটির মাধ্যমে। তিনি অতি চমৎকারভাবে সংগ্রহ পদ্ধতিটি আলোচনা করেন, যা পরবর্তীতে ফোকলোর অনুরাগীদের ক্ষেত্র সমীক্ষা বিষয়ে আগ্রহী করে তুলে, তবে তিনি লোকসাহিত্যকেন্দ্রিক উপাদান সংগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে অধ্যায়টিতে আলোকপাত করলেও লোকশিল্পকেন্দ্রিক উপাদান সংগ্রহের বিষয়ে কোন কৌশল বা পদ্ধতি আলোচনা করেননি।
ক্ষেত্রসমীক্ষার ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারের বিষয়ে অবশ্য তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ড. ইসলাম ফোকলোর উপাদান সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতির গুরুত্বের কথা বললেও এই অধ্যায়ের এক পর্যায়ে তিনি নিজেই বলেছেন ‘প্রবন্ধে যেসব পদ্ধতি বা রীতিনীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোই চূড়ান্ত এমন কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। আসলে সংগ্রাহকের নিজের ওপরেই সমগ্র সংগ্রহ কর্মের সাফল্য নির্ভর করে”।৩ অর্থাৎ তিনি নিজেই এক্ষেত্রে তার উদারনৈতিক ধ্যানধারণার পরিচয় দিয়েছেন এবং গবেষণার ক্ষেত্রে যে সবসময় প্রথাগত নিয়ম চলেনা সেটাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন। আর এই মানসিকতা তাঁকে একজন আন্তর্জাতিক মানের গবেষক হিসাবে যেমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছে তেমনি এদেশে ফোকলোর গবেষণার ক্ষেত্রেও একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা যোগ করেছে।
মূলত তাঁর হাত ধরেই ফোকলোরের বিজ্ঞানধর্মী আলোচনার সূচনা সারা ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর পূর্বে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগত ফোকলোর বিশ্লেষণ নিয়ে অন্য কারো সুশৃঙ্খল ধারণার বহিঃপ্রকাশ চোখে পড়েনা। ড. ইসলামের আলোচনার মধ্যে দিয়ে পাশ্চাত্য ফোকলোর আর এই প্রাচ্য ফোকলোরের তুলনামূলক আলোচনা একটি নতুন ধারার জন্ম দেয়, যা ড. ইসলামের আন্তর্জাতিক চেতনাকে আরও সুসংহত করে।
‘ফোকলোর সম্পর্কিত প্রচলিত মতবাদ’ চতুর্থ অধ্যায়ের এই হলো শিরোনাম। ড. মযহারুল ইসলাম আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি. করার সময়ই বিভিন্ন মতবাদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করেন।
ফোকলোরের উপাদান বিশ্লেষণে এই মতবাদ বা মেথডগুলো যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সত্যটি সামনে রেখেই তিনি তাঁর গ্রন্থে এ সংক্রান্ত আলোচনাকে খুব সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। এদেশীয় লৌকিক উপাদানের আলোকে মতবাদগুলিতে বর্ণিত পদ্ধতির প্রয়োগে আত্মনিবিষ্ট হয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকটি মতবাদের ইতিহাস, পদ্ধতি, তথা মূল কথাটিকে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের জন্য অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন। প্রয়োজনে বোঝার সুবিধার্থে বিভিন্ন জ্যামিতিক ডায়াগ্রামের ব্যবহারও তিনি করেছেন। এ থেকে উপলব্ধি করা যায় তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারা। বাংলা ফোকলোরের উপাদানকে এসব মতবাদের আওতাভুক্ত করেন তিনি।
এ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়টির শিরোনামটি বেশ চমকপ্রদ। ‘বাংলা লোকসংগীতের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’। কেননা পাঠক কেবল লোকগীতিকা এবং লোককাহিনীর ক্ষেত্রেই রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতির প্রয়োগ লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এই প্রবন্ধে অভিনিবিষ্ট হয়েই লক্ষ্য করা যায় ড. ইসলাম বাংলা লোকসংগীতের বেশ কিছু ধারা যেমন বাউল গানের মত জটিল সঙ্গীতটিও তিনি রূপতাত্ত্বিক পদ্ধতির আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। এক্ষেত্রে বাউল গান গ্রহণ করাটিকেও তাঁর সাহসী ও বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপরূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। সংগীতগুলোকে যে বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন রেখাচিত্র এবং ডায়াগ্রামিক ছকে বিন্যস্ত করেছেন তা কেবল প্রবন্ধটি পাঠের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন ‘ইউরোপ আমেরিকাতে এ যাবৎ রূপতত্ত্বগত বা কাঠামো বিচারগত যেসব আলোচনা হয়েছে তার অধিকাংশই লোককাহিনী অথবা লোকগীতিকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। লোকসঙ্গীতের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রায় হয়নি বলা যায়। লোকসঙ্গীতের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সত্যিকারভাবেই একটি দুরূহ ব্যাপার। বিশেষ করে তা যদি বাউল গানের মত হয় ভাব ও রূপকাশ্রয়ী।৪ এ অধ্যায়ে আরও একটি বিষয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী আলোচনা স্থান পেয়েছে। লোককাহিনী সম্পাদনার রীতি ও পদ্ধতি এক্ষেত্রে তিনি এদেশীয় চারটি কাহিনীকে সংগ্রহ করে তা সম্পাদনা করেছেন। লোককাহিনী সম্পাদনার ক্ষেত্রে যা পরবর্তীতে মডেল হিসাবেও ব্যবহার হতে পারে। কারণ এতে তাঁর নিজস্বতা রয়েছে। কাহিনীগুলোর মোটিফ ও টাইপ নির্ণয়ের পাশাপাশি প্রত্যেকটির তুলনা ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করেছেন। ‘নায়কের প্রত্যাগমনে সাহায্যকারী বালিকা’ শীর্ষক বিভিন্ন দেশীয় কাহিনীতে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পদ্ধতিকে আশ্রয় করে বিশ্লেষণ করেছেন। সবশেষে তিনি উপমহাদেশীয় লোককাহিনীর ‘বোকা জামাতা বা পেটুক জামাতা’ শীর্ষক কাহিনীগুলো উল্লেখ পূর্বক বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। অধ্যায়ের শেষ অংশ এবং সমগ্র অধ্যায়টি পাঠ করলে লোককাহিনী বিশ্লেষণ ও পাঠ সম্পর্কে পাঠক একটি স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে।
এরপর ষষ্ঠ অধ্যায়টিতেও লোককাহিনীর বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাপকভাবে তাঁর গঠনমূলক আলোচনা কৌতুহলী পাঠকের দৃষ্টি আরো গভীরে নিয়ে যায়। শুরুতেই তিনি বাংলাদেশ পাক ভারতের কাহিনী পঠন পাঠনে বিদেশী প-িতদের অবদান ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন। পরক্ষণেই তিনি ইউরোপীয় লোককাহিনীর আফ্রিকান, ইন্ডিয়ান, আমেরিকান পাঠান্তরের প্রক্রিয়া ও স্বরূপ সম্পর্কে তাঁর আলোচনাকে উপস্থাপন করেছেন। বিষয়টি ফোকলোর সম্পর্কে তাঁর এই আন্তর্জাতিক ভাবনাকে আরও প্রসারিত করেছে।
এ অধ্যায়ের শেষ অংশটিতে এসে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এই অংশটির নামকরণই যে কোন মননশীল পাঠককে পাঠ করার ক্ষেত্রে আগ্রহ জাগায়। চীন দেশীয় লোককাহিনীকে খুব সাবলীলভাবে ড. ইসলাম আঙ্গিক ও ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষক হিসাবে ড. ইসলামের ভাবনা যে কেবল আঞ্চলিক পর্যায়ে ছিল না বরং ফোকলোরের আন্তর্জাতিক পঠন পাঠনে তাঁর আগ্রহ ও দখল যে কী দৃঢ় ছিল তা চীনা কাহিনী বিশ্লেষণেই ধারণা করা যায়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো ড. ইসলাম তাঁর প্রায় সব লেখাতেই বিবরণ নয় বিশ্লেষণধর্মী ফোকলোর চর্চার কথা বলেছেন। যেখানে তাঁর সমসাময়িক গবেষকরা কাহিনী সংকলন প্রকাশ করেছে, সেখানে তিনি কেবল এদেশীয় কাহিনীগুলোই নয় বরং চীনা, ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা প্রায় সবদেশের লোককাহিনীকেই ফোকলোর মেথড অনুসারে বিশ্লেষণ করেছেন। আর ফোকলোর সাধকরূপে আন্তর্জাতিকভাবে তাঁর মূল স্বীকৃতির কারণ এখানেই।
সপ্তম অধ্যায়ের প্রথমদিকে তিনি প্রখ্যাত আমেরিকান গবেষক এ্যালান ডাল্ডেজ প্রণীত মেটাফোকলোর তত্ত্বের আলোচনা ও প্রয়োগ করেছেন। সম্ভবত তাঁর এ আলোচনার পূর্বে বাংলাদেশে কোন ফোকলোরবিদই মেটাফোকলোর বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন কথা বলেননি। তাঁর এ আলোচনা ফোকলোর আগ্রহীদের ভাবনা ও কৌতুহলে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মেটাফোকলোরকে পরা ফোকলোর হিসাবে বাংলায় উল্লেখ করেন এবং বাংলা প্রবাদের নিরিখে তার আলোচনাও করেন।
এই অধ্যায়েই তিনি বাংলা লোককাহিনী ও পুরাকাহিনী এবং Ballads এর আলোচনাও করেন। ইংরেজী লোকগীতিকা সম্পর্কে তাঁর ধারণা যে কত সুদৃঢ় ছিল তা প্রবন্ধ পাঠেই পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এখানে তিনি ইংরেজী Ballads গুলোর আঙ্গিক, চরিত্র, শিল্প ও নির্মাণ কৌশলগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণাধর্মী আলোচনার চেষ্টা করেছেন। তিনি এ অধ্যায়টিতে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। এর একটি হলো ‘বাংলাদেশের আধুনিক সমাজ ও ফোকলোর’। ড. ইসলামের সার্বক্ষণিক ধ্যান ধারণাতে ফোকলোর অগ্রজস্থান অধিকার করেছিল। বাংলাদেশের আধুনিক লোকগোষ্ঠীর মাঝেও ফোকলোর কীভাবে ছিল আছে এবং থাকবে এ বিষয়ে তাঁর মন্তব্য পাঠক মাত্রেই স্বীকার করবে। বাংলাদেশের অর্থনেতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এদেশীয় জনগণ যে ফোকলোরকেই লালন করছে এবং করবে এ কেন্দ্রিক একটি Message দেবার চেষ্টা ড. ইসলাম প্রবন্ধটিতে করেছেন।
সর্বোপরি বাংলাদেশের নদীমাতৃক জনগোষ্ঠী যতই বৈঠা ছেড়ে ইঞ্জিন চালিত স্টিমারে চড়–ক না কেন তবুও তার উদাস করা বাউল ভাটিয়ালির আবেদন শেষ হবে না, এই বিষয়ই প্রবন্ধটিতে উঠে এসেছে। প্রবন্ধটি অতি আধুনিক পাঠককেও তার শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই গ্রন্থের সর্বশেষ অধ্যায়টির গুরুত্ব বহুমাত্রিক। ‘বর্তমান বিশ্বে ফোকলোর’ শীর্ষক এই প্রবন্ধটিতে ড. ইসলাম সমগ্র পৃথিবীর ফোকলোর চর্চার ইতিহাস ও ধারা পরিক্রমাকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। জার্মান, রাশিয়া, গ্রেটব্রিটেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়াসহ প্রায় সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ফোকলোরের অগ্রগতি ও গবেষণা সম্পর্কে পাঠককুল একটি পর্যায়ক্রমিক ধারণা পেতে পারে। এই অধ্যায়ে জনসংযোগের ক্ষেত্রে এবং জাতীয়তাবোধে ফোকলোরের প্রয়োগের বিষয় কেন্দ্রিক আলোচনাও স্থান পেয়েছে।
সবশেষে বলা যায় গ্রন্থের অধ্যায় পরিকল্পনা, শিরোনাম, সন্নিবেশিত বিষয় আন্তর্জাতিক ভাবনা গ্রন্থটিকে গুরুত্বের আসনে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় উপাদান-উদাহরণের ব্যাপক ব্যবহার গ্রন্থটির কলেবর বৃদ্ধি করেনি। বরং আন্তর্জাতিক মেথড পদ্ধতি ও তত্ত্ব অনুসরণ করে এ সবের বিশ্লেষণ করা হয়েছে; যা ড. মযহারুল ইসলামের ফোকলোর ভাবনায় দূরদৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ড. ইসলাম তাঁর জীবনে, কর্মে ধ্যানে ফোকলোরকে লালন করেছেন আন্তর্জাতিক চেতনা দিয়ে যা তাঁকে করে তুলেছে কালোত্তীর্ণ।
তথ্যনির্দেশ
১. ড. মযহারুল ইসলাম, ফোকলোর পরিচিতি ও পঠন-পাঠন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ. ভূমিকা।
২. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২।
৩. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২১।
৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩০।
লেখক: সুদীপ্তা জোয়ার্দ্দার, কলকাতা প্রবাসী