শুক্রবার, ২০ মে ২০২২, ১২:৪১ পূর্বাহ্ন
১৯৬৬ সাল, সময়টা ছিল আগস্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাস। ক্লাশে ঢুকলেন সুদর্শন এক তরুণ যুবক। প্রথমেই নিজের পরিচয়টা দিলেন। নাম- এ.কে.এম. হাসানুজ্জামান। পৈত্রিক নিবাস রাজশাহী শহরে। পাশা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে। নিজের পরিচয় দেয়ার পর পরিচয় নিলেন আমার চার সহপাঠীর। তখন আমি অনার্স পড়তাম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর তিনি বড়ুচন্ডী দাসের ‘শ্রী কৃষ্ণকীত্তন’ কাব্য পড়াতে শুরু করলেন। মিষ্টি চেহারা, গায়ের রং কাঁচা হলুদে মাখা। কি অপূর্ব সৌন্দর্য। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম স্যারের বাচনভঙ্গি ও চোখমুখের দিকে। ক্লাশ শেষ হবার পর আমার নাম ধরে ডেকে বললেন- তুমি আমার সঙ্গে পরে দেখা করবে।
এই যে একজন শিক্ষককে ভালো লাগা, অতঃপর তাঁর স্নেহের বন্ধনে পড়া এটা কম সৌভাগ্যের বিষয় নয়। স্যার বাসা নিয়েছিলেন রাধানগরে। ঈশ্বদী রোডের প্রায় সংলগ্ন বাসাটি। আমি প্রায় স্যারের বাসায় যেতাম। স্যার একদিন তাঁর ছাত্র জীবনে তৈরি করা অনেকগুলো নোট আমার হাতে তুলে দিলেন, আরো বললেন যখন যে বইয়ের দরকার হবে আমাকে বলবে।
সে সময় বাংলা বিভাগে অনেক বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন। অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক হাবিবুন্নবী, অধ্যাপক মো. ইদরীস আলী, অধ্যাপক খালেকুজ্জামান প্রমুখ। তাঁরা সবাই তাঁদের পান্ডিত্য ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করতেন। ঐ সালেই আনোয়ার পাশা সাহেব চলে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে (৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একজন)। নিয়মিত ক্লাশ নিতেন দুইজন শিক্ষক। এ.কে.এম. হাসানুজ্জামান ও মো. ইদরীস আলী। আমরা অনার্সের ছাত্ররা যে কারণে এই দুইজন শিক্ষকেই বিশেষভাবে স্মরণ করি।
হাসানুজ্জামান স্যার অতি দক্ষতার সঙ্গে ক্লাশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তাঁর ক্লাশে টু-শব্দ করার শক্তি কারো ছিলো না। এছাড়া সে সময়ে এডওয়ার্ড কলেজে যত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো তার নিয়ন্ত্রণের ভার ছিলো স্যারের উপর। এমনকি পরীক্ষা কেন্দ্রকে নকলমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিলো অপরিসীম। প্রতিদিনের পরীক্ষা কেন্দ্রে তিনি এক বা একাধিক পরীক্ষার্থীকে নকলের দায়ে বহিষ্কার করতেন। এ কারণে তিনি এডওয়ার্ড কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম সাহেবের অতি আস্থাভাজন শিক্ষক ছিলেন। আমিনুল ইসলাম সাহেব স্বাধীনতা উত্তরকালে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। কলেজের অনেক কমিটিতে হাসানুজ্জামান স্যার সদস্য অথবা আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি সে সময় ‘ফ্রি স্টুডেন্টশীপ’ কমিটির সদস্য। সভা শেষে স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। দেখা করলাম। স্যার বললেন- তুমি দরখাস্ত করো নি কেন? আমি বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলাম- স্যার আমি শিক্ষাবোর্ড থেকে বৃত্তি পাচ্ছি, এ কারণে কলেজের সাহায্যপ্রার্থী হই নি। তবুও স্যার বললেন- তুমি আবেদন করলে তোমাকে ফ্রি স্টুডেন্টশীপ দিতে পারতাম। এই যে ভালোবাসা, এই যে শুভেচ্ছা এটা আমাকে শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগী হতে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছে।
আমি যখন অনার্সের মৌখিক পরীক্ষা দেয়ার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি স্যার মুস্তাফা নূর উল ইসলামকে আমার জন্য একটি চিঠি দিয়েছিলেন। স্যার মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে ছিলেন না। স্যারের অনুগ্রহের প্রয়োজন হয় নি। এম.এ. পাশ করার পর ঐবছরই পিএইচ.ডি. ডিগ্রী করার জন্য বাংলা একাডেমীর বৃত্তি পেয়েছিলাম। সংবাদটা স্যারকে দিয়েছিলাম রাজশাহীতে তাঁর বাসায় গিয়ে। স্যার এতো খুশি হয়েছিলেন যে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- তুমি একদিন ডিগ্রী পাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবে, তুমি মস্তবড় গবেষক হবে। স্যারের আশীর্বাদ ব্যর্থ হয় নি। আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রী লাভের পর বাংলা একাডেমী থেকে আমার থিসিসটি প্রকাশ পায়। বইটা দেয়ার জন্য গেলাম স্যারের হেতেমাখাঁর বাসায়। সে দিন স্যার হাসতে হাসতে বলেছিলেন- আমি জানতাম তুমি বড় গবেষক হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। একথা শোনার পর আমি আবেগ-আপ্লুত হয়ে স্যারে পদধূলি মাথায় গ্রহণ করেছিলাম।
স্যারের জীবনের মূল্যবান অংশ অতিক্রান্ত হয়েছে রাজশাহী কলেজের অধ্যাপনায়। স্যার এই কলেজেও জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আমার শ্যালক মো. শরীফ (মুক্তিযোদ্ধা), মো. শামীম, সেলিম আক্তার খোকন (অস্ট্রেলিয়ার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), ছোটন সবাই রাজশাহী কলেজে তাঁর ছাত্র। এমনকি আমার ছেলে জুবায়ের আহমেদ শিমন যখন রাজশাহী কলেজে আই.এস.সি- তে অধ্যয়নরত তখন স্যার তারও শিক্ষক। বলতে কি আমার শ্বশুর পরিবারসহ আমরা পিতা-পুত্র সবাই স্যারের ছাত্র। এছাড়া তাঁর কন্যা ডা. তানিয়া আমার জ্যেষ্ঠ কন্যা লায়লা জেসমিন জলির সহপাঠী। ওরা একসঙ্গে পড়তো রাজশাহী পিএন গার্লস হাইস্কুলে। স্যার অবসর পেলেই আমার বাসাতে বেড়াতে আসতেন। আর আমার যখনই একেকটি নতুন বই প্রকাশ পেতো স্যারকে দেয়ার জন্য হেতেমখাঁর বাসায় যেতাম। ভাবী নিজের হাতের তৈরি নানা উপভোগ্য খাবারে আমাকে আপ্যায়িত করতেন। স্যার যখন কারো সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতেন সহাস্যে বলতেন- জলিল আমার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। সত্যিই তখন আনন্দে আমার বুক ভরে যেতো।
আমার মনে হয় এই শহরের প্রায় প্রতিটি পরিবারে স্যারের এক বা একাধিক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। তিনি কখনো সহকর্মীদের সঙ্গে কলহে লিপ্ত হয় নি। দায়িত্ব পরিহার করেন নি। তাঁর মতো সদাচারী শিক্ষক এই শহরে খুব বেশি নেই। তিনি এ মাসের ১৩ তারিখে অকস্মাৎ ইন্তেকাল করেন। তাঁর শোকের ছায়া আমার হৃদয়ের মতো আরো অসংখ্য হৃদয়কে বেদনাহত করেছে। এমন একজন গুণী শিক্ষক ও সজ্জনকে নিয়ে আমরা যদি একটি স্মারকগ্রন্থ প্রণয়ন করতে পারি তাহলে সেটাই হবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অনন্য নিদর্শন।
*উপ-উপাচার্য, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী।