শুক্রবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১, ০১:০৯ পূর্বাহ্ন
আমার জন্মকাল থেকে শুরু করে আমার কৈশোর, যৌবনকালের একটা বড় অংশ আমার গ্রামেই কেটেছে। আমার প্রকৃত জন্ম তারিখ ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৭ সাল। আব্বা আমার নাম রেখেছিলেন ‘খালেদ’। আব্বা-আম্মা-পরিবার এবং গ্রামের অন্যান্য গুরুজনেরা আমাকে ‘খালেদ’ বলেই জানেন এবং এখনও আমাকে তাঁরা খালেদ নামেই ডাকেন। কিন্তু গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব যিনি আমাদের স্কুলের ধর্ম বিষয়ক শিক্ষক ছিলেন, মেট্রিকের ফরম পূরণের সময় তিনি আমার নাম করে দিয়েছিলেন ‘মোহাম্মদ আবদুল খালেক’। মেট্রিকের ফরম পূরণের সময় আমাদের কালে শিক্ষকগণই শিক্ষার্থীদের জন্মের তারিখ ঠিক করে দিতেন। মেট্রিক পরীক্ষার ফরম পূরণের দায়িত্বে ছিলেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক ‘শ্রী গজেন্দ্রনাথ ধাম’। তিনি ইচ্ছেমত শিক্ষার্থীদের জন্ম তারিখ বসিয়ে দিয়েছিলেন। আমার শিক্ষকের দেয়া জন্ম তারিখ ১৯ আগস্ট ১৯৩৭ সাল। মেট্রিকের সার্টিফিকেটে সেভাবেই আমার জন্মের সাল তারিখ লিপিবদ্ধ হয়েছে। কর্মজীবনে মেট্রিক সার্টিফিকেটের জন্ম সাল তারিখকেই মেনে চলতে হয়। তবে পারিবারিক ভাবে আমার জন্ম তারিখ ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৭ সাল।
শুধু জন্ম তারিখ নয়, হিন্দু এবং মুসলিম শিক্ষকের হস্তক্ষেপে আমার নামের আরও বিভ্রাট ঘটে গেছে। হিন্দু শিক্ষকগণ মনে করতেন মুসলমান ছেলেদের নামের শুরুতে থাকবে ‘মোহাম্মদ’ এবং শেষে থাকবে ‘মিয়া’। হিন্দু-মুসলিম দুই শিক্ষকের বদৌলতে আমার নাম হয়ে গেছে ‘মোহাম্মদ আবদুল খালেক মিয়া’। কিন্তু আমাদের পারিবারিক পদবী ‘সরকার’। তবে এ পদবী আব্বার নাম পর্যন্তই এসেছে, আমাদের কোন ভাইয়ের নামের সাথে ‘সরকার’ পদবী ব্যবহার করা হয় নি।
যে গ্রামে আমার জন্ম সে গ্রামের নাম ‘চরনবীপুর’। বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার উত্তর প্রান্তের শেষ গ্রামটি ‘চরনবীপুর’। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যে গ্রামে বসবাস করতেন, সে গ্রামটির নাম ছিল ‘নবীপুর’। যতদূর জানা যায় মুঘল আমলে আমাদের এলাকার পূর্বাঞ্চলের যমুনা নদী ভাঙ্গা কিছু পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে এসে যেখানে বসতি স্থাপন করেন, সেই বাস্তুহারা মানুষেরা গ্রামটির নাম রাখেন নবীপুর। গ্রামটির নামকরণ দেখে মনে হয় সেখানে মুসলিমদের প্রাধান্য ছিল। নবীপুর গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছিল করতোয়া নদী। ফলে গ্রামটিতে নৌপথে যাতায়াতের বেশ সুবিধা ছিল। মুসলিম শাসনামলে ‘নবীপুর’ গ্রামকে কেন্দ্র করে খাজনা আদায়ের জন্য গড়ে ওঠে ‘নবীপুর’ মৌজা। নবীপুর মৌজা শাহজাদপুর থানার অধীনে।
নবীপুর গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী এক পর্যায়ে নবীপুর গ্রামের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এক সময় নদীটি গ্রাম থেকে বেশ দূরেই ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে নদী ‘নবীপুর’ গ্রামের দিকে সরে যেতে থাকে। করতোয়া নদী তখন ছিল খুব খর¯্রােতা। নদীটির পূর্বপাড় যেমন ভাঙ্গতে থাকে, পশ্চিমপাড় তেমনি জাগতে থাকে। প্রথমের দিকে নবীপুর গ্রামের ঘরভাঙ্গা কিছু মানুষ নতুন জেগে ওঠা পশ্চিমপাড়ের চরে এসে বসতি স্থাপন করেন, গ্রামটির নামকরণ হয় ‘ডিক্রিরচর’। নাম থেকেই বুঝতে পারা যায় মামলা মকদ্দমার পর ‘ডিক্তি’ অর্জনের মাধ্যমে যাঁরা এ গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন তাঁরাই গ্রামটির নাম রেখেছিলেন ‘ডিক্রির চর’। গ্রামটির বর্তমান বিবর্তিত নাম ‘ডিগ্রিচর’। গ্রামটির আকৃতি তেমন বড় নয়, জনবসতি কম। তবে গ্রামটিতে একটি ডাকঘর আছে এবং বড় আকারের পুরাতন একটি মাদ্রাসা আছে।
করতোয়া নদী দিনের পরদিন পূর্বদিকে সরতেই থাকে এবং এক পর্যায়ে করতোয়া নদী প্রায় সমগ্র ‘নবীপুর’ গ্রামটিকেই গ্রাস করে নেয়। গ্রামটি যখন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়, গ্রামের নদী ভাঙ্গা পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি কিছুটা সরে এসে নদীর পূর্বপাড়েই বসতি স্থাপন করেন। গ্রামের নাম অপরিবর্তিত থাকে। নদী ভাঙ্গা কিছু পরিবার নদী থেকে প্রায় মাইল খানেক পশ্চিমে এসে অনেক আগে জেগে ওঠা চরের ওপর বসতি স্থাপন করেন। গ্রামটির নামকরণ হয় ‘চরনবীপুর’। নিজেদের আদি গ্রামের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই বোধ করি গ্রামটির নামকরণ হয় ‘চরনবীপুর’। চরনবীপুর গ্রামে যাঁরা বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সরকার বংশের প্রাধান্য ছিল। সরকার বংশেই আমার জন্ম। হিন্দু সম্প্রদায়ের যে সমস্ত মানুষ ‘চরনবীপুর’ গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন তাদেরও অনেকের বংশীয় পদবী ছিল ‘সরকার’। যেমন মহেন্দ্র কুমার সরকার, সচীন্দ্রকুমার সরকার ইত্যাদি। তবে আমাদের গ্রামের শুরু থেকেই মুসলিম জনগোষ্ঠির সংখ্যা ছিল বেশি।
আমাদের ‘চরনবীপুর’ গ্রামের যখন জন্ম হয় তখন করতোয়া নদী উল্লাপাড়ার ঘাটিনা ব্রিজের নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে সোনতলা, চরতারাবাড়ীয় চরনবীপুর গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে টেপরি গ্রাম পর্যন্ত গিয়ে নদীটি আবার উত্তর-পূর্বমুখী হয়ে মাইল খানেক উত্তর দিকে গিয়ে আবার পূর্বদিকে ধাবিত হয়েছে। নলসোন্দা, খামারউল্লাপাড়া গ্রাম দুটোকে বাম দিকে রেখে এরপর ধাবিত হয়েছে সোজা দক্ষিণ দিকে। চলার পথে বাতিয়া, নরিনা শাহজাদপুরের পূর্ব পাশ দিয়ে নদীটি বেড়ার দিকে চলে গিয়ে যমুনা নদীতে মিলিত হয়েছে। করতোয়া নদীটি আঁকা-বাঁকা চলতে গিয়ে আমাদের চরনবীপুর গ্রামের পশ্চিম, দক্ষিণ এবং পূর্বদিকটি বেষ্টিত করে ফেলেছে। তিনদিকে নদী বেষ্টিত হওয়ার ফলে আমাদের গ্রামটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে বটে, তবে অকাল বন্যার কারণে জমি থেকে ফসল পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠতো। চরনবীপুর গ্রামের ফসলী জমির মাটি ছিল খুব উর্বর, ধান, পাট, তিল-কাউনে সারা বছর মাঠ পরিপূর্ণ থাকতো, তবে বর্ষাকালে জমিতে কোন ফসল থাকতো না, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র মাস জুড়ে গ্রামের তিন পাশে পানি থৈ থৈ করতো। শ্রাবণ মাসে শাপলা-শালুকে ভরে যেতো মাঠ, ভাদ্র-আশ্বিনে মাঠের কোন কোন অঞ্চলে ফুটে উঠতো পদ্মফুল। সবকিছু মিলিয়ে সে এক অপূর্ব দৃশ্য। গ্রামের এই প্রাকৃতিক পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা।
বর্ষা বিধৌত আমাদের এলাকার বাড়িগুলো বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য ৮/১০ হাত উঁচু করে মাটি ফেলে ঘর নির্মাণ করা হতো। অনেকটা টিলার মত। আমাদের বাড়িতে ছিল দুটি আঙ্গিনা। ভেতরের আঙ্গিনা ছিল ঘরবেষ্টিত। মাঝখানে ছোট একটি উঠান। বাইরের আঙ্গিনা ছিল প্রশস্ত। সেখানে জমির ফসলাদি মাঠ থেকে নিয়ে এসে মলন-মাড়াই শেষে ফসল ঘরে তোলা হতো। ঘরে ফসল তোলা নিয়ে আমার একটি স্মৃতি আছে। আমার বয়স তখন ৭/৮ বছর মত হবে। সন্ধ্যা নেমে আসছে, আষাঢ় মাস। আউশধান রোদে শুকিয়ে ঘরের মাচায় তোলার হিড়িক। বাইরের আঙ্গিনা থেকে ধান শুকিয়ে ঘরে তোলা হচ্ছে। কাজের মেয়েকে সাথে নিয়ে মা ধান ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত। আমাকে রাখা হয়েছে ধান পাহারায়, কাজ মুরগী তাড়ানো। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসছে। হঠাৎ বাড়ির পাশের উত্তরের জঙ্গল থেকে একটি শেয়াল বের হয়ে এসে আমার চোখের সামনে থেকে একটি মুরগী ধরে নিয়ে গেল। ভয়ে আমি বেশ চীৎকার করেছিলাম। মা একটি তামার পয়সা আগুনে পুড়িয়ে পানিতে ডুবিয়ে সে পানি আমাকে পান করিয়েছিলেন। মা মনে করতেন যে কোন ভয়ের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য তামার পয়সা পোড়ানো পানি অত্যন্ত উপকারি।
বর্ষাকালে আমাদের গ্রামে চলাফেরার একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে হলেও নৌকা ব্যবহার করতে হতো। হাট-বাজার আমরা নৌকাযোগেই করতাম। বর্ষা ঋতু ছাড়া অন্যান্য ঋতুতে আমাদের গ্রাম থেকে বাইরে যাতায়াত খুব কষ্টকর ছিল। সাইকেল ছাড়া অন্য কোন বাহন ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। পায়ে হেঁটেই সবাইকে চলাফেরা করতে হতো। করতোয়া নদী একদিকে ছিল আমাদের গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূল উৎস, অন্যদিকে করতোয়া নদীর জন্য আমাদেরকে কম বিড়ম্বনা সইতে হয় নি। আমাদের গ্রামের পশ্চিমে করতোয়া নদী, নদী পার হয়ে এলে পাওয়া যেতো ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা, যে রাস্তা দিয়ে আমরা থানা সদর শাহজাদপুর এবং রেল স্টেশন উল্লাপাড়ায় যাতায়াত করতাম। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাটি এখন বিশ্বরোডে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের গ্রামের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য করতোয়া নদীতে এখনও কোন সেতু নির্মিত হয় নি, ফলে আমাদের গ্রামের শিক্ষা, অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও যাতায়াত ব্যবস্থা আগের মতই রয়ে গেছে। গ্রামে যেতে হলে খেয়া নৌকা থেকে নামবার সময় পা থেকে জুতো-স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে খেয়া নৌকা থেকে আমাদেরকে হাটু পানিতে পা ডোবাতে হয়। বাড়িতে যখন যাই, করতোয়ার পানিতে পা ডোবাতে এখনও বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করি, তবে এ সুযোগ অথবা এ দুর্ভোগ বোধ করি আর বেশিদিন পোহাতে হবে না। আমাদের গ্রামের পাশে করতোয়া নদীতে সেতু নির্মাণের কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। খেয়াতরী আর থাকবে না। করতোয়ার জলে পা ডোবানোর সুযোগটাও হারিয়ে যাবে।
আমাদের ছেলেবেলায় গ্রামে বাজার-পাঠশালা যেমন ছিল না, ঈদের সময় নামাজ পড়বার কোন মাঠও আমাদের গ্রামে ছিল না। আমাদের গ্রামের পূর্বদিকে বিশাল ফসলী মাঠ, সেই মাঠ পার হয়ে গেলে পাওয়া যাবে এক গ্রাম, দূরত্ব দেড় মাইল মত হবে, গ্রামের নাম নলসোন্দা। সে গ্রামে বাস করতেন এক পরহেজগার আলেম, ডিগ্রিচর মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করতেন, নাম মৌলানা জাবেদ আলী। সৎ, ধর্মভীরু মানুষ হিসেবে এলাকায় তাঁর বিপুল খ্যাতি ছিল। শুধু তাঁর পেছনে নামাজ পড়বার আকর্ষণেই পথে যত অসুবিধাই হোক না কেন, আমরা নলসোন্দা ঈদের মাঠে নামাজ পড়তে যেতাম। নলসোন্দা গ্রামের অবস্থান একটু নিচু এলাকায়। বর্ষাকালে নৌকা যোগে নলসোন্দা গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ ছিল বটে, কিন্তু বর্ষার পানি যখন নেমে যেতো, প্রায় দু’মাস রাস্তা-ঘাট কর্দমাক্ত হয়ে থাকতো। নলসোন্দা গ্রামের পথচারীদের কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকতো না।
চান্দ্র মাসের গণনা অনুযায়ী ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে ছয় ঋতু তথা ১২ মাসের ঈদের অভিজ্ঞতা আমার হৃদয়ে জমা হয়ে আছে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যখন ঈদ অনুষ্ঠিত হতো, আমরা নৌকা নিয়ে নলসোন্দা গ্রামে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করতাম। নামাজে যাতায়াতে আমাদের এক ধরনের নৌকা বাইচও হয়ে যেতো। নলসোন্দা গ্রামটি ছিল নীচু এলাকায়, কিন্তু ঈদের নামাজ আদায় করবার জন্য দশ গ্রামের মানুষ মিলে মাটি তুলে ঈদের মাঠটিকে বেশ উঁচু করে রেখেছিল যাতে বর্ষাকালে ঈদের নামাজ আদায়ে অসুবিধা না হয়।
প্রতিটি মানুষের পক্ষেই ৮/১০ বছর বয়সের আগের স্মৃতি মনে রাখা কঠিন। আমার জন্যও তা প্রযোজ্য। ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গ যখন পূর্বপাকিস্তানে রূপান্তরিত হয়, আমার বয়স তখন ১০ বছর। আমাদের আব্বা ছিলেন প্রখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। আব্বা রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পন্থী। সংসারে আমরা তখন ৪ ভাই, আমাদের কোন বোন ছিল না। বড় ভাই মযহারুল ইসলাম তখন রাজশাহী কলেজে বাংলা বিষয়ে অনার্স পড়ছিলেন। পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান আমরা তাঁর কাছ থেকেই রপ্ত করেছিলাম। ১৯৪৭ সালের ঈদের স্মৃতি আমার কিছুটা স্মরণে আছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে আনন্দ উৎসবের জন্য গ্রামে গ্রামে নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়েছিল। সময়টি ছিল শ্রাবণের শেষ এবং ভাদ্রের প্রথম পর্যায়। নৌকা বাইচের মত পানি তখন এলাকার নদী-বিলে ছিল। যতদূর মনে পড়ে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে কোরবানীর ঈদ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। একদিকে পাকিস্তান অর্জন, অন্যদিকে ঈদ উৎসব, সবকিছু মিলিয়ে বেশ একটা জমজমাট পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তান অর্জনের পর প্রথম ঈদ উদ্যাপন উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা তোলার আয়োজন করা হয়েছে। গ্রামে কে কত উঁচুতে পতাকা তুলতে পারে, তার একটা প্রতিযোগিতা চলছিল। বড়ভাই মযহারুল ইসলামের সাথে আমরা পাকিস্তানের একটা পতাকা লম্বা বাঁশের মাথায় বেঁধে আমাদের বাড়ির গরুর রাখালকে একটা লম্বা আমগাছে তুলে দিয়ে বলা হলো পতাকা লাগানো বাঁশটিকে আমগাছের সর্বোচ্চ মগডালে বেঁধে দিতে হবে। আমাদের বাড়ির রাখালটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পতাকা লাগানো বাঁশটিকে আম গাছের মগডালে স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিল।
আমরা ঈদের নামাজ আদায় করতাম নলসোন্দা ঈদগাহ ময়দানে। আমাদের গ্রামের পূর্বদিকে নলসোন্দা গ্রাম। দূরত্ব দেড় মাইল মত হবে। নৌকা ছাড়া সেখানে যাবার কোন পথ নেই। আমাদের গ্রাম থেকে ১৫/২০টি নৌকা নিয়ে সবাই ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম নলসোন্দা ঈদগাহ ময়দানে।
এ কালে যেমন ঈদ এলে নতুন কাপড়-চোপড় কেনার হিড়িক পড়ে যায়, আমাদের ছোটবেলায় গ্রামে তেমনটি দেখি নি। তবে পুরাতন কাপড় ধোয়া এবং পরিস্কার করার অতি উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। গ্রামে যার যেমন সামর্থ, সেই সামর্থ অনুযায়ী তারা কাপড় পরিস্কার করেছে। কেউ সাবান দিয়ে, কেউ সোডা দিয়ে অথবা খার দিয়ে পুরাতন কাপড়গুলো পরিস্কার করে ঈদের দিনে পরিধান করা হতো। আমরাও নিজেদের কাপড় নিজেরাই পরিস্কার করে হাতে হাতে ইস্ত্রি করে নিতাম।
ঈদের নামাজের সময় দেয়া থাকতো বেলা ১০টা, কিন্তু বেলা ১২টার আগে নামাজ শুরু করা যেতো না, কারণ গ্রামের লোকজনের কাছে ঘড়ি তখন কমই ছিল। বিভিন্ন দিক থেকে নামাজীরা আসতে থাকতো, তাদেরকে বাদ দিয়ে কেউ নামাজ পড়তে চাইতো না, এর ফলে দেখা যেতো বেলা ১২টার আগে নামাজ আদায় সম্ভব হতো না।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ঈদের স্মৃতি যতটুকু মনে পড়ে তা হলো সকাল বেলা মায়ের হাতের তৈরি দুধ পায়েস খেয়ে আমরা নৌকাযোগে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। মাঝারী ধরনের আমাদের একটি নৌকা ছিল। নৌকাতে আমাদের পরিবার এবং প্রতিবেশীদেরসহ মোট ১০/১২ জন নৌকায় স্থান হয়েছিল। বাড়ি থেকে পূবের মাঠে নৌকা নিয়ে পেছনের দিকে তাকাতেই দেখা গেল আমাদের আমগাছে মগডালে লাগানো পাকিস্তানের পতাকা পত পত করে উড়ছে। গ্রামের অন্য কোন বাড়িতে এত উঁচু স্থানে কেউ পতাকা তুলতে পারে নি। বেলা ১০টার দিকে নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করতেই দেখা গেল আমাদের গ্রাম এবং আশে-পাশের গ্রামে অসংখ্য ছোট-বড় নৌকা ঈদের মাঠের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। নৌকা নিয়ে চলতে গেলেই নৌকা বাইচের একটা প্রবণতা এসে যায়। নৌকা বাইচ দিতে গেলে জামা-কাপড় ভিজে যাবে, একথা ভেবে নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় সবাই একটু সংযত থাকে, তবে ফিরবার পথে সংযত ভাব আর থাকে না। পুরোপুরি নৌকা বাইচ শুরু হয়ে যায়।
আমাদের সময় নলসোন্দা ঈদের মাঠে কোন সামিয়ানা টাঙানো হতো না, প্রচন্ড রোদ-বৃদ্ধির মধ্যেই আমাদেরকে ঈদের নামাজ আদায় করতে হতো। শুধু ইমাম সাহেবের জন্য ছোট একটি চাদোয়া টাঙানো থাকতো। নলসোন্দা ঈদের মাঠে নামাজ আদায় করবার একটি বড় আকর্ষণ ছিল খতিব মৌলানা জাবেদ আলী সাহেব। সুদর্শন চেহারা, অত্যন্ত নরম সুরে কথা বলতেন, শুদ্ধ উচ্চারণে নামাজ পড়াতেন, নামাজ শেষে দীর্ঘ সময় ধরে মোনাজাত করতেন। দীর্ঘ মোনাজাতের সময় ক্লান্ত হয়ে আমরা মাঝে মাঝে হাত নামিয়ে ফেলতাম। রোদ হোক, বৃষ্টি হোক, কোন অবস্থাতেই মৌলানা জাবেদ আলী সাহেব তাঁর মোনাজাতকে ছোট করতেন না। মুসল্লীদের যত কষ্টই হোক, সবাই গভীর নিষ্ঠার সাথে মোনাজাতের সময় আমিন আমিন বলে ধ্বনি উচ্চারণ করতেন। নামাজ শেষে মৌলানা জাবেদ আলী সাহেবের সাথে হাত মেলানো এবং দোয়া নেয়ার জন্য বিশাল লাইনে দাঁড়াতে হতো। যত বিলম্বই হোক তাঁর কাছে গেলে তিনি আমাদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করতেন। মৌলানা সাহেবের বিনয়ী, হাসিমাখা নূরানী চেহারা দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম।
বর্ষাকালের ঈদগুলোতে নানারকম দুর্ভোগ পোহাতে হতো। মনে পড়ে কোন এক বছর বড় বন্যার কারণে নলসোন্দা ঈদগাহ ময়দান পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছিল, এলাকায় এমন কোন বাড়ি ছিল না, যে বাড়িতে বন্যার পানি ওঠে নি। শেষ পর্যন্ত ঈদের মাঠে সমস্ত নৌকা একত্রিত করে নৌকাতেই আমরা ঈদের নামাজ আদায় করেছিলাম।
শরৎকালে ‘নলসোন্দা’ ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ আদায় করা আমাদের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর ছিল। নৌকা চলতো না, পথের কোথাও পানি, কোথাও শুকনো। স্যান্ডেল হাতে নিয়ে কাদাপানির মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঈদগাহ ময়দানে যেতে হতো। শীতকাল এবং বসন্তকালে আমরা একটু শান্তিমত ঈদের নামাজ আদায় করতে পারতাম। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরমে, তীব্র রোদের মধ্যেও নামাজীদের কাউকে ছাতা ব্যবহার করতে দেয়া হতো না। পরকালে দোজখের আগুনে মানুষের কেমন কষ্ট হবে, তা বোঝানোর জন্য ছাতা ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। এ ব্যবস্থাটি ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।
ঈদের দিন-তারিখ নিয়ে আমরা দু’একবার বিড়ম্বনায় পড়েছি। ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে মত পার্থক্য সে সব বিড়ম্বনার মূল কারণ। বর্ষা ঋতুর কোন এক ঈদের কথা আমার মনে আছে। আকাশ মেঘলা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে কোথাও চাঁদ দেখা যায় নি। পশ্চিম পাকিস্তানে চাঁদ দেখার খবরের ওপর ভিত্তি করে ‘নলসোন্দা’ মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। আমাদের আব্বা নানারকম যুক্তি দেখিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের চাঁদ দেখা ঈদের নামাজ বর্জন করেন। আব্বার সাথে আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই সে বছর ‘নলসোন্দা’ মাঠের ঈদের নামাজ বর্জন করেন। পরদিন আমরা গ্রামের সবাই নৌকা নিয়ে দূরের একটি ঈদগাহ ময়দানে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছিলাম। আমাদের মত সে অঞ্চলের মানুষও পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঈদের চাঁদ দেখা অনুযায়ী আগের দিন ঈদ করতে সম্মত হন নি।
আমাদের কালে আমাদের গ্রামের মানুষের সামাজিক বন্ধন বেশ মজবুত ছিল। গ্রামের মানুষের মধ্যে কোন রকম দলাদলি ছিল না। গ্রামের প্রতিটি মানুষ আমাদের আব্বাকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। গ্রামের মানুষের বিচার-সালিশ আব্বাকেই করতে হতো। গ্রামের পরিবেশ এতটা শান্ত ছিল যে, আমাদের গ্রামে পুলিশ ঢুকবার মত কোন ঘটনা কখনও ঘটে নি। আশেপাশের দশ গ্রামের মধ্যে আমাদের গ্রাম ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। ঈদের দিন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে আমরা ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আসতাম। সে সময় আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিল অতিশয় দরিদ্র। ঈদের দিনে উন্নত মানের খাবার তৈরির সামর্থ তাঁদের ছিল না। আমাদের বাড়িতে মা প্রচুর পরিমাণ চালের পায়েস রান্না করে রাখতেন। আমাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনেরা মায়ের হাতের পায়েস খুব পছন্দ করতেন।
আমি যখন স্কুলে পড়তাম, গ্রামে একটি সামাজিক সংগঠনের জন্ম দিয়েছিলাম নাম ‘প্রগতি সংঘ’। প্রগতি সংঘের আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীকালে আমাকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রগতি সংঘের একটি ভাল মানের ফুটবল টীম ছিল। আমি ভাল খেলতে না পারলেও আমাকে ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। ঈদের দিনে আমাদের গ্রামের প্রধান আকর্ষণ ছিল বিবাহিত খেলোয়াড় এবং অবিবাহিত খেলোয়াড়দের মধ্যে ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতা। সেকালে গ্রামের যুবকদের মধ্যে অল্পবয়সে বিয়ে করবার প্রবণতা ছিল। অবিবাহিত যুবকদের টীমও খুব খারাপ ছিল না। ফলে খেলাটি সব সময় উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠতো। বিবাহিত দলের পক্ষে তাদের স্ত্রীরাও অবস্থান গ্রহণ করতো। মাঠে তারা আসতে পারতো না। মাঠের আশে-পাশের বাড়ীতে বসে তারা খেলা দেখার চেষ্টা করতো। ঈদের দিনের এ খেলাটিকে কেন্দ্র করে গ্রামের যুবক-যুবতী এমন কি পৌঢ়-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মধ্যেও টান টান উত্তেজনা বিরাজ করতো।
বর্ষাকালে ঈদ হলে ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতা করা যেতো না। বর্ষাকালে আমাদের গ্রামের ফুটবল খেলার মাঠ পানিতে ডুবে যেত। সে ক্ষেত্রে ঈদের দিনের বড় আকর্ষণ ছিল নৌকা বাইচ। আমাদের চরনবীপুর গ্রাম, নলসোন্দা এবং ডিগ্রিচর গ্রামের মাঝখানে ছিল এক বিশাল বিল অঞ্চল। এখানেই ঈদের দিনে আমরা নৌকা বাইচের আয়োজন করতাম। আয়োজন খুব বড় হতো না। শুধুমাত্র এলাকার নৌকাগুলো নিয়ে নৌকা বাইচের আয়োজন করা হতো। তবে ঈদের দিনের নৌকা বাইচের আলাদা আকর্ষণ ছিল। বর্ষাকালে গ্রামের মানুষের মাঠে কোন কাজ থাকতো না। নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বড় বড় পান্সী নৌকার পাশাপাশি ছোট ছোট নৌকাগুলোকেও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হতো। নানারকম সারিগান গাইতে গাইতে নৌকাগুলো বাইচের স্থানে উপস্থিত হতো। নৌকা বাইচ শেষে সারিগান গাইতে গাইতে তারা নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যেতো। সারিগানগুলোর মধ্যে একে অপরকে বিদ্রƒপ করে তাৎক্ষণিকভাবে সারিদারগণ নানা সারিগান রচনা করতেন। যেমন-
শিয়াল তুমি বাঘ চেনো না,
বাঘের হাতে পড়লে তবে কৈরা দিব লৈটানা।
শিয়াল তুমি বাঘ চেনো না, …
এর উত্তরে প্রতিপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে সারি রচনা করে ফেলতেন-
আম গাছে সুপারি ধরে, কাঁঠাল গাছে তাল
খঞ্চন পক্ষীর নাচনা দেখে হে
ওরে ব্যাঙে মারে ফালরে
আম গাছে সুপারি ধরে …
সারিগানগুলো এখনও আমার কানে বাজে। নৌকা বাইচ, ফুটবল খেলা, এসব নিয়েই কাটিয়েছি আমার ছোটবেলা, আমার গ্রামের ঈদ। আমার গ্রামের ঈদের স্মৃতিগুলো এখনো আমার জীবনে চির অমর চির ভাস্বর হয়ে আছে।